অনলাইন ডেস্ক :: চতুর্থ ধাপে আগামী ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া কক্সবাজারের চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনকে নির্যাতনে অভিযুক্ত গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন তথা নৌকা প্রতীক না দেওয়ার দাবি উঠেছে। এ সংক্রান্ত একটি লিখিত অভিযোগ দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরে প্রেরণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ চকরিয়া উপজেলা শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত এই অভিযোগ গত বৃহস্পতিবার দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের অভিযোগ সেলে জমা দেওয়া হয়েছে।
দলের প্রধানের কাছে দেওয়া লিখিত অভিযোগে বলা হয়, চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক একজন সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি। তাঁর কাছে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের জনগণ কোনভাবেই নিরাপদ নয়। তিনি ২০১৪ সালের ১৮ অক্টোবর দিবাগত রাতে দিগরপানখালী গ্রামের শিক্ষক নারায়ণ দাশকে গুলি করে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি মদদ দেন। অবৈধভাবে কবজায় নেওয়া প্রায় দুই একর জমি দখল পাকাপোক্ত করতে শিক্ষক নারায়ণ দাশকে হত্যার পর মামলার বাদীসহ (নারায়ণের ছোট ভাই জয়শঙ্কর দাশ) পুরো পরিবারকে ভারতে চলে যেতে বাধ্য করা।
শুধু তাই নয় সাবেক পৌর কাউন্সিলর লক্ষ্মণ কান্তি দাশকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা, তাঁর মাটি কাটার একটি এক্সকাভেটর পেট্রল দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া এবং তাঁর পৈতৃক বাড়ির চারদিকের মাটি কেটে পুকুর করারও ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে গিয়াসের বিরুদ্ধে।
সংখ্যালঘু নির্যাতন, শিক্ষক নারায়ণ হত্যাকাণ্ডে মদদদান, মামলার বাদীসহ পরিবারকে দেশান্তরে বাধ্য করার অভিযোগ : পৌরসভার দিগরপানখালীর প্রফুল্ল কুমার দাশ ওরফে সাঁচিরামের পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত দুই একর জায়গা রয়েছে ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের রাজারবিল মৌজার ডেইলপাড়ায়। সেই জায়গা গিয়াসের ভাই ও আত্মীয়-স্বজন দখলে নেয়। প্রফুল্ল কুমার আদালতের দ্বারস্থ হন। মামলার সব কিছু দেখাশোনা করছিলেন তাঁর বড় ছেলে শরীরচর্চা শিক্ষক নারায়ণ দাশ। এ অবস্থায় ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা ২০১৪ সালের ১৮ অক্টোবর ভোররাতে বাড়িতে ঢুকে শিক্ষক নারায়ণকে ঘুমন্ত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে। এ সময় তাঁর বৃদ্ধ মা-বাবা ও ছোট ভাই জয়শঙ্কর আহত হন। এ ঘটনায় জয়শঙ্কর বাদী হয়ে থানায় মামলা করলেও গিয়াসের প্রভাবে সেই মামলা হিমাগারে। মামলায় গিয়াসকে সরাসরি আসামি করতে না পারলেও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে তাঁর দিকেই ইঙ্গিত করেন মামলার বাদীসহ পুরো পরিবার। মামলাটি বর্তমানে সিআইডি পুলিশ তদন্ত করছে।
মামলার বাদী জয়শঙ্কর দাশের অভিযোগ, পৈতৃক সম্পত্তি জবরদখলে রাখতে তাঁর ভাই নারায়ণকে গুলি করে হত্যায় মদদ দেন গিয়াস উদ্দিন। কিন্তু তিনি সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় তাঁকে আসামি করতে পারেননি। যাঁদের আসামি করা হয়েছিল, তাদেরও পুলিশ ওই সময় গ্রেপ্তার করতে না পারায় প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে তাঁরা নিজ বাড়ি ছেড়ে পৌর শহরে ভাড়া বাসায় ওঠেন। সেখানেও থাকতে না পেরে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আগরতলায় নিকটাত্মীয়ের বাড়িতে চলে যান।
শিক্ষক নারায়ণের বোনজামাই শিক্ষক রূপন কান্তি দে বলেন, ‘গিয়াস উদ্দিন চেয়ারম্যানের ভাইসহ তাঁর লোকজন প্রতিনিয়ত মামলা তুলে নিতে হুমকি দিয়ে আসছিলেন বাদীকে। পরিবারের সদস্যদের নারায়ণের মতো একই পরিণতি ভোগ করার হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। এই অবস্থায় আমার বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ি, মামলার বাদীসহ (শ্যালক) পরিবারের সদস্যরা প্রাণ রার্থে ভিটাবাড়ি ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন।’
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ চকরিয়ার সভাপতি রতন বরণ দাশ জানান, শিক্ষক নারায়ণ দের পৈতৃক সম্পত্তি জবরদখলে রাখেন গিয়াসের ভাই-স্বজনরা। বিয়ের ১০ দিন আগে নারায়ণকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর মামলার বাদী, তাঁর মা-বাবাসহ পরিবার সদস্যদের হুমকি দেওয়া চলতে থাকে।
তিনি বলেন, ‘অবিলম্বে শিক্ষক নারায়ণের বৃদ্ধ বাবা-মা, মামলার বাদী ভাইসহ পরিবারের সদস্যদের স্বদেশে ফিরিয়ে এনে আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াসের দখল থেকে সহায়-সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি সরকারের কাছে।’
গিয়াস কর্তৃক নির্মম নির্যাতনের শিকার আরেক ভুক্তভোগী সাবেক পৌর কাউন্সিলর লক্ষ্মণ কান্তি দাশ। ঘুনিয়া মৌজায় তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তি অবৈধভাবে দখলে রাখতে তাঁকেও গুলি করে হত্যার চেষ্টা হয়। সশস্ত্র সন্ত্রাসী দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয় তাঁকে। এ সময় তাঁর প্রায় ৩০ লাখ টাকা মূল্যের এক্সকাভেটর পেট্রল দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এমনকি দিগরপানখালী গ্রামে লক্ষ্মণের পৈতৃক বাড়ির চারদিকের মাটি কেটে পুকুর খনন করেন গিয়াস। এ ঘটনায় লক্ষ্মণ কান্তি দাশ তার বিরুদ্ধে তৎসময়ে মামলা করতে পারেনি থানায়। এর পর আদালতে গিয়াসের বিরুদ্ধে মামলা করলেও সেই মামলা গতি পায়নি গিয়াসের প্রভাবের কারণে। এ নিয়ে নতুন করে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি লক্ষ্মণ কান্তি দাশ।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ চকরিয়া শাখার সভাপতি তপন কান্তি দাশ ও সাধারণ সম্পাদক বাবলা দেবনাথ কর্তৃক দলের প্রধান শেখ হাসিনার কাছে দেওয়া লিখিত অভিযোগে দাবি করা হয়েছে, গিয়াস উদ্দিন একজন সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি। তিনি আওয়ামী লীগের মতো একটি অসাম্প্রদায়িক দলের ভেতর ঘাপটি মেরে থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনকে অত্যাচার-নির্যাতন করেছেন। এমনকি সর্বশেষ শারদীয় দুর্গোৎসবের সময় পূজামণ্ডপে হামলায়ও ইন্ধন জোগায়। তার কারণে ফাঁসিয়াখালী ও পৌরসভার দিগরপানখালী গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন আতঙ্কে থাকেন। এসব বিষয় তারা লিখিতভাবে কেন্দ্রকে অবহিত করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কক্সবাজার জেলা এবং চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা বলেন, ‘চকরিয়ার গিয়াসের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনকে নির্যাতনের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু এসব অপকর্ম করেও সে কীভাবে পার পেয়ে যায় তা আমাদের বুঝে আসে না।’
পাহাড় সাবাড় ও পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগ ঃ ফাঁসিয়াখালীর সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় ও বন্য হাতির অভয়ারণ্য ধ্বংস করার ঘটনায় ২০০৯ সালে বন বিভাগ মামলা করলে উপজেলা জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত গিয়াসকে ছয় মাসের কারাদণ্ডাদেশ এবং ১০ হাজার টাকার অর্থদণ্ড দেন। এর পরও থেমে থাকেনি তাঁর পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড। প্রতিনিয়ত উচিতারবিল ও আশপাশের পাহাড় কেটে সেই মাটি বাইরে বিক্রি এবং নিজের ইটভাটায় ব্যবহার করে আসছেন। সংরক্ষিত বনভূমির বহু একর জায়গাও দখলে রাখার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
ফাঁসিয়াখালী বন রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘এর আগে যাঁরা আমার স্থলাভিষিক্ত ছিলেন, তাঁরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিভিন্ন প্রতিবেদন দিয়ে গেছেন। সেসব প্রতিবেদনে ফাঁসিয়াখালী সংরক্ষিতবনাঞ্চল উজাড়ের নেপথ্যে গিয়াসের নাম রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বন বিভাগের স্বল্পসংখ্যক জনবল নিয়ে প্রভাবশালীদের সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব হয়ে ওঠে না।’
আওয়ামী লীগের স্থানীয় জ্যেষ্ঠ নেতারা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের রাজনীতির অন্যতম আদর্শ হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা। কিন্তু গিয়াস উদ্দিন লালন করেন সাম্প্রদায়িকতা ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি। শিক্ষক নারায়ণ হত্যাকাণ্ড এবং এই মামলার বাদিসহ তাঁর পুরো পরিবারের দেশান্তরি হওয়ার পেছনে গিয়াসের হাত রয়েছে।’
তারা আরো বলেন, ‘অনেক দিন থেকে শুনছি, গিয়াস উদ্দিন সংরক্ষিত বন ধ্বংস করছেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনকে নির্যাতন করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ নিয়ে বসে আছেন শুধু এসব কুকর্ম চালাতে। গিয়াসের মতো তাঁর চার ভাইও যেন বনের মধ্যে রাজত্ব কায়েম করেছেন। এতে তাঁরা রাতারাতি কয়েকশত কোটি টাকার মালিক বনেছেন। এখনই তাদের অপকর্মের লাগাম টেনে ধরা উচিত।’
তবে এসব অভিযোগের ব্যাপারে গিয়াস উদ্দিন বলেছিলেন ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ সত্য নয়। বন উজাড়ের কোনো মামলা বা অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে নেই। আমার ইটভাটারও লাইসেন্স রয়েছে। ইটভাটার আশপাশে কোনো পাহাড় নেই এবং পাহাড় সাবাড়েরও কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে দলের মধ্যে একটি অংশ আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে।’ -সূত্র কালের কন্ঠ
পাঠকের মতামত: